শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল!
— নাইম ইসলাম নিবির।
শেখ রাসেল এক অনুভূতির নাম, এক অনিন্দ্যসুন্দর দুরন্ত শিশুর নাম, এক চেতনার নাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম, যিনি বঙ্গবন্ধুপরিবারকে আলোকিত করে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই ফুটফুটে শিশু যখন পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি জরুরি কাজে চট্টগ্রামে ছিলেন।
পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক দার্শনিক ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু তার এই পঞ্চম সন্তানের নাম রাখেন শেখ রাসেল। অত্যন্ত আদরে বেড়ে ওঠা শিশু রাসেল ছিলেন টগবগে এক গোলাপকলির মতো। অপার সম্ভাবনাময় বুদ্ধিদীপ্ত শিশু রাসেলের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়া। কারণ বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তির সংগ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হয়েছে রাজবন্দি হিসেবে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছিলেন শিশু রাসেল।
১৯৭১ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে-বাতাসে শোভা পেল লাল-সবুজের পতাকা। অপার বিস্ময় নিয়ে দেখতে লাগলেন পরিবর্তনশীল পৃথিবীকে। পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সফরেও ছিল শেখ রাসেলের স্টাইলিশ উপস্থিতি। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই বাবাকে অনুসরণ করতেন। ১৯৭৫ সালে শেখ রাসেল পড়তেন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ৪র্থ শ্রেণিতে, তখন তার বয়স ১১ বছর। তিনি সাইকেল চালাতে খুব পছন্দ করতেন। রাষ্ট্রীয় কোনো প্রোটোকল ছাড়া অন্যান্য ছেলের মতো সাইকেলে করে স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার, সেদিনও প্রতিদিনের মতো খুব সকালে মসজিদ থেকে যখন মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে ভেসে আসছিল নামাজের জন্য, কল্যাণের জন্য আসার আহ্বান; ঠিক তখনই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গর্জে ওঠে বিশ্বাসঘাতক নরপিশাচদের পৈশাচিক বুলেট। পাশবিক সশস্ত্র ঘাতক সেদিন শিশুপুত্র রাসেলসহ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল।
পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর আর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। বুলেটের শব্দ, রক্ত আর আত্মচিত্কারে আতঙ্কিত হয়ে কেঁদে কেঁদে রাসেল বলেছিলেন, আমি মায়ের কাছে যাব। পরে মায়ের লাশ দেখে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করে বলেছিলেন, আমাকে হাসু আপার কাছে (শেখ হাসিনা) পাঠিয়ে দিন। মা-বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও চাচা—সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সব শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় রাসেলকে।
ছোট শিশুর বুকটা তখন যন্ত্রণায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাদের সান্নিধ্যে, স্নেহ-আদরে হেসেখেলে বড় হয়েছেন, তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে তার মনের অবস্থা কী হয়েছিল? কেনইবা এত কষ্ট দিয়ে একটি নিষ্পাপ শিশুকে বুলেটের আঘাতে এভাবে হত্যা করা হয়েছিল? বঙ্গবন্ধুর আদরের সন্তানের কী অপরাধ ছিল? এ প্রশ্নের জবাব কি কখনো পাওয়া যাবে?
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম নেওয়া শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৫৬ বছর। তিনি বেঁচে থাকলে শামিল হতে পারতেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে। তিনি হয়তো বিশ্বসেরা গবেষক, বিজ্ঞানী অথবা জাতির পিতার মতো শান্তি প্রতিষ্ঠার কান্ডারি কিংবা হতে পারতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই স্বমহিমায় উজ্জ্বল মানবতার কান্ডারি। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালির জাতির পিতা, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা বিশ্বশান্তির অগ্রদূত বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উওরসূরি হিসেবে দেশ, জাতি ও বিশ্বের কল্যাণে শেখ রাসেল হতে পারতেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
শেখ রাসেলের জন্মদিনে আদরের ছোট ভাইয়ের হাজারো স্মৃতি হাতড়ে কেঁদে ওঠেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। একই সঙ্গে এই বলে আফসোস করেন, রাসেল বেঁচে থাকলে অনেক কিছু করতে পারত। শেখ রাসেল সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগঘন কণ্ঠে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আজ দেখতে কেমন লাগত রাসেলকে?’ শিশুদের প্রতি ছিল তার অনেক দরদ। শিশুদের সে কিছু না কিছু দিত। বঙ্গবন্ধু দরিদ্র মানুষের সঙ্গে নিজের খাবার ভাগ করে খেতেন। ঠিক সেই গুণটিও ছিল রাসেলের মধ্যে। গ্রামে গেলে দরিদ্র শিশুদের যে কিছু দিতে হবে, এটাও ছিল চিন্তার মধ্যে। কিন্তু ঘাতকেরা এমন ছোট শিশুকেও বাঁচতে দেয়নি।
শেখ রাসেল বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশি সময় কাছে পেতেন না, তাই উদগ্রীব হয়ে থাকতেন বাবার কাছে যাওয়ার জন্য। বাবার জন্য কান্নাকাটি করতেন। বঙ্গবন্ধু তার কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘একদিন জেলখানায় দেখা করতে এসে দুই বছরের শিশু রাসেল বলল, আব্বা বাড়ি চলো। কী উওর দিব। ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট ছেলেটা ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে, শত হলেও আমি তো মানুষ—ওর জন্মদাতা পিতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শেখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়ি।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লিখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে শেখ রাসেলের কত স্মৃতি আর আবেগঘন মুহূর্তের কথা লিখেছেন, তা হূদয় দিয়ে উপলব্ধি করার বিষয়। চোখে জল চলে আসে আমাদের ছোটবেলার কথা চিন্তা করে।
শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে তিনি আজ তার হাসু আপার (জননেত্রী শেখ হাসিনা) হাতকে শক্তিশালী করে দেশের উন্নয়নকে আরো গতিশীল করতে পারতেন। হতে পারতেন আগামী বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। শেখ রাসেলের ১১ বছরের জীবনগাথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইটি আমাদের দেশে খুদে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে হবে। শিশুদরদি ও মানবদরদি শেখ রাসেল আজ দেশের শিশু-কিশোর-তরুণ এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে একটি চেতনা, একটি আদর্শের নাম। ভালো থেকো রাসেল—শুভ জন্মদিন।
নাইম ইসলাম নিবির : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
nayemulislamnayem148@gmail.com